আটলান্টিক মহাসাগরের জানা-অজানা নানা তথ্য

 

আটলান্টিক মহাসাগরের ভূমিকাঃ

 

আটলান্টিক মহাসাগর বা অতলান্তিক মহাসাগর ও বলা হয়। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। শুনতে অবাক লাগলেও, এ মহাসাগর টি প্রায় পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ এবং পৃথিবীর মোট জলভাগের ২৯ ভাগ। আটলান্টিক মহাসাগর এর আকৃতি ইংরেজি এস অক্ষরের মত। 




আটলান্টিক মহাসাগরের নামের উৎপত্তি


আটলান্টিক মহাসাগর এর অর্থ এটলাসের সমুদ্র। গ্রীকদের মতে জ্যোতির্বিজ্ঞানে একজন গ্রিক দেবতার নাম এটলাসের নাম অনুসারে অ্যাটলান্টিস নামের উৎপত্তি হয়। এবং তাই আটলান্টিক মহাসাগর নামে পরিচিত হয়। যদিও উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরকে বলা হতো ইথিওপিয়ান  মহাসাগর। তারও আগে ইংরেজদের কাছে এটি পরিচিত ছিল গ্ৰেট ওয়েস্টার্ন ওসান নামে।

আটলান্টিক মহাসাগরের অবস্থান


আটলান্টিক মহাসাগরের পশ্চিমে, উত্তর আমেরিকা মহাদেশ এবং দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ। এবং এর পূর্বে, ইউরোপ মহাদেশ ও আফ্রিকা মহাদেশ। মহাসাগর টি উত্তরে উত্তর মহাসাগর থেকে দক্ষিনে দক্ষিণ মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তরে ডেনমার্ক প্রণালী, গ্রীনল্যান্ড সাগর, নরওয়েজিয়ান সাগর এবং বারেন সাগর হয়ে আর্টিক মহাসাগর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। পশ্চিমে দক্ষিণ আমেরিকার  কেপ হর্নে প্রশান্ত মহাসাগরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। দক্ষিণে আফ্রিকার কেপ আগুলাসের সাথে ভারত মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। এই মহাসাগর টি, আমেরিকাকে ইউরেশিয়া এবং আফ্রিকা কে বিভক্ত করেছে।

আটলান্টিক মহাসাগরের আয়তন,অবস্থা এবং পানি

 পৃথিবীর প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ এলাকা জুড়ে আটলান্টিক মহাসাগর অবস্থিত। আটলান্টিক মহাসাগরের আয়তন ১০ কোটি ৬৪ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে, উত্তর আটলান্টিকে ৪ কোটি ১৪ লক্ষ  ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এবং দক্ষিনে ৪ কোটি ২ লক্ষ ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রান্তিক মহাসাগর সহ এ মহাসাগরের উপকূলীয় দৈর্ঘ্য ১ লক্ষ ১১ হাজার ৮৬৬ কিলোমিটার।

 আটলান্টিক মহাসাগরের গড় গভীরতা ৩ হাজার ৬৪৬ মিটার বা ১১ হাজার ৯ শত ৬২ ফুট।পুয়ের্ত  রিকো ট্রেন্স  বা মিলাওয়াকি ডিপ এই মহাসাগরের সবচেয়ে গভীরতম এলাকা। সেখানকার  গভীরতা ৮ হাজার ৩ শত ৭৬ মিটার বা ২৭ হাজার ৪ শত ৮০ ফুট।প্রতিধ্বনি প্রযুক্তির মাধ্যমে মিলওয়াকি ডিপের সর্বপ্রথম গভীরতা নির্ণয় করে এক ব্রিটিশ নাগরিক। এ মহাসাগরের পানির পরিমাণ ৩১কোটি ৪ লক্ষ ১০ হাজার ১০০ ঘন কিলোমিটার।

বিশ্বের বিপদজনক জলরাশির তালিকায় রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর দ্বিতীয়তে। পৃথিবীর প্রধান প্রধান নদীর জলধারা আটলান্টিকের সঙ্গে এসে মিশেছে। এগুলোর মধ্যে মিসিসিপি নদী, নাইজার নদী, কঙ্গো নদী অ্যামাজন নদী ইত্যাদি।

দুইটি সাগর কিংবা দুটি বিশাল জলরাশি সংযুক্তকারী সরু জলপথকে বলে প্রণালী। আটলান্টিক মহাসাগরে এরকম অনেকগুলো প্রণালী রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য
ডেনমার্ক প্রণালী,ম্যাজেলান প্রণালী এবং ফ্লোরিডা প্রণালী ইত্যাদি।

আটলান্টিক মহাসাগরে পানির লবণাক্ততা, স্রোত এবং দুর্যোগ অবস্থা

আটলান্টিক মহাসাগরের পানি ও উপকূলীয় বাতাস ও পানির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও পানির স্রোত দ্বারা প্রভাবিত। পৃথিবীর আবর্তন গতি, বায়ুপ্রবাহ,  সমুদ্রের জলের লবণাক্ততার ঘনত্ব ও উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য সমুদ্রের জলরাশি নিয়মিতভাবে একস্থান হতে অন্য স্থানে প্রভাবিত হয়। 

আটলান্টিক মহাসাগরে যেসকল স্রোত গুলো হয়ে থাকে তা হল কুমেরু স্রোত, বেঙ্গুয়েলা স্রোত, দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত , ব্রাজিল স্রোত, উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত , উপসাগরীয় স্রোত,  উত্তর আটলান্টিক স্রোত এবং ক্যানারি স্রোত ইত্যাদি।

  উত্তর আটলান্টিক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর শীতকালে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল গুলোতে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। তবে দক্ষিণ আটলান্টিকে ঘূর্ণিঝড় না হয় বললেই চলে।

আটলান্টিক মহাসাগর সম্পর্কে নানান ধারণা

গবেষকদের ধারণা  ৯৮০ সালের দিকে নর্স অভিযাত্রী এরিক দা রেড সর্বপ্রথম আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিল। তবে ১৪৯২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস এ সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করেন। এরপর সর্বপ্রথম ১৯১৯ সালে আটলান্টিক মহাসাগর বিমান পথে পাড়ি দেওয়া হয়।জন আলকোকো, আর্থার ব্রাউন নামক পাইলট কানাডা হতে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আয়ারল্যান্ডে এসেছিলেন। এছাড়াও ১৯৭৮ সালে তিন অভিযাত্রী বেলুনে করে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন।

আটলান্টিক মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জ





আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সবচেয়ে বড় দ্বীপ হচ্ছে গ্রিনল্যান্ড। যার আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে ১৫ গুন বড়। ভূগোল জয়ী সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কে আটলান্টিক মহাসাগরের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য দ্বীপগুলো হলো গ্রিনল্যান্ড, বারো দ্বীপ, আইসল্যান্ড, বাহামা দ্বীপ, বার্বাডোস দ্বীপ ,ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ ইত্যাদি। এছাড়াও আরো অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপপুঞ্জ রয়েছে এই আটলান্টিক মহাসাগরে।

আটলান্টিক মহাসাগরের পানি কেমন?



 ধারণা করা হয় আটলান্টিকের পানি খুবই শীতল। তবে অনেক অঞ্চলে এর পানি খুবই উষ্ণ। সাধারণত এর পানির তাপমাত্রা নির্ভর করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রভাবের উপর। গ্ৰীষ্মকালে মার্কিন উপকূলে এর পানির তাপমাত্রা প্রশান্ত মহাসাগরের পানির চেয়ে 16 ফারেনহাইট বেশি । তাছাড়া মৌসুমভেদে পরিবর্তন ও জলবায়ু পরিবর্তনে পানির তাপমাত্রা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। 

সময়ভেদে কিছু কিছু অঞ্চলে আটলান্টিক মহাসাগরের পানি বরফেও পরিণত হয়। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে জুন পর্যন্ত এই মহাসাগরে ল্যাবরাডো সাগর বাল্টিক মহাসাগর ও গ্রীনল্যান্ড প্রণালী বরফ হয়ে থাকে। আরেকটি বিষয় হলো উত্তর আটলান্টিকের পানির তাপমাত্রা যদি ঘড়ির কাঁটার  দিকে ঘুরে তাহলে দক্ষিণ আটলান্টিক এ পানির স্রোত বিপরীত দিকে ঘুরে।

আটলান্টিক মহাসাগরের পানি অন্যান্য সাগরের পানির চেয়ে লবণের পরিমাণ একটু বেশি। তবে বিভিন্ন স্থানে লবণাক্ততার মান বিভিন্ন রকম। আটলান্টিকের পানির রং অন্যান্য সাগরের পানির রং এর চেয়ে আলাদা। সাধারণত অন্যান্য সাগরের পানির রং নীল বর্ণের হয়ে থাকে। কিন্তু আটলান্টিক মহাসাগরের পানি রং কিছুটা সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে।

 আটলান্টিক মহাসাগরের নিচের বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে এক প্রকার রঞ্জক পদার্থের কারনে পানি সবুজ দেখা যায়। এমনকি ভূমধ্য সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরে মিলিত স্থলে পানির রং আলাদা আলাদা। আটলান্টিক মহাসাগরে অনেক জাহাজ চলাচল করে আর এ কারণেই আটলান্টিক মহাসাগরের পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশে বিভিন্ন জলজ প্রাণী জন্য দিন দিন মারাত্মক হয়ে যাচ্ছে।

আটলান্টিক মহাসাগর এর মাছের পরিমাণ

পৃথিবীর প্রায় ২৫ ভাগ মাছ আটলান্টিক মহাসাগর থেকে পাওয়া যায়। আটলান্টিক মহাসাগরে সবথেকে বেশি মাছ পাওয়া যায় গ্র্যান্ড ব্যাংকস, স্কটিস শেলফ, জর্জেস শেলভ ও আশেপাশের জলরাশি ফান্ডি উপসাগর ,উত্তর সাগরে  ইত্যাদি। সারাবিশ্বে তিন ভাগে বিভক্ত মৎস্য ভান্ডার এর মধ্যে দুই ভাগ আটলান্টিকে।

আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে খনিজ সম্পদ

বিভিন্ন তথ্য মতে আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে মাইল দুয়েক এলাকা জুড়ে প্রায় ২ লাখ টন স্বর্ণের সন্ধান পাওয়া গেছে । তবে এ সোনা পানির নিচ থেকে উত্তোলনের  কোন উপায় এখনো আবিষ্কার হয়নি। পাশাপাশি প্রাকৃতিক গ্যাস,  অপরিশোধিত তেল, মূল্যবান পাথরের ভান্ডার ইত্যাদি বিদ্যমান রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরে। ফ্লোরিডা প্রণালীর উত্তর কিউবায় প্রায় ৮৭কোটি  ঘনমিটার প্রেট্রোলিয়াম ,৯.৮ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

আটলান্টিক মহাসাগরের নিচে জাদুঘর

আটলান্টিক মহাসাগরে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে সাগরতলে প্রথম জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। সাগরের ১৫ মিটার নিচে এ জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়। এ জাদুঘর স্পেনের একজন শিল্পী তৈরি করেন। যা দেখতে হলে ডুবড়ির পোশাক পরে অক্সিজেন এবং ওয়াটার গ্লাস ব্যবহার করতে হবে।

আটলান্টিক মহাসাগরের রহস্যজনক স্থান




আটলান্টিক মহাসাগরের এলাকা হচ্ছে বারমুডা ট্রাঙ্গেল। আটলান্টিক মহাসাগরের এই সীমান্ত দিয়ে অনেক জাহাজ এবং অনেক উড়োজাহাজ উধাও হয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ